পারিবারিক অশান্তি, প্রেমিকের বশ, বা জীবনের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের জন্য একদল নারী আশ্রয় নিয়েছিলেন এক ‘তান্ত্রিক বাবা’র কাছে। কিন্তু সমাধানের বদলে তাদের কপালে জুটেছে হাতে দগদগে পোড়া ক্ষত, হারানো সম্মান, আর ব্ল্যাকমেইলের শিকার হওয়ার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। মে থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত এমন অন্তত ৩০ জন নারী ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিয়েছেন, যাদের হাত পোড়ার কারণ কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং এক ভয়ংকর রাসায়নিক প্রতারণা।
চিকিৎসকদের কাছে প্রথমে এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন মনে হলেও, পরবর্তীতে জানা যায়, এর পেছনে রয়েছে একটি সুপরিকল্পিত প্রতারণার চক্র। ভুক্তভোগীদের নির্দেশ দেওয়া হতো বাজার থেকে চিনি ও একটি বিশেষ রাসায়নিক পদার্থ কিনে হাতের মুঠোয় ধরে রাখার জন্য। এই পদার্থটি আসলে ছিল পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ইকবাল রউফ মামুন জানান, এই রাসায়নিক পদার্থ চিনির সঙ্গে মিশলে জারণ বিক্রিয়ায় প্রচণ্ড তাপ উৎপন্ন হয়, যা অ্যাসিডের মতো চামড়া পুড়িয়ে দেয়। 'বদ জিন' বা মন্ত্রের কোনো সম্পর্ক এতে নেই।
এই প্রতারকরা প্রথমে ফেসবুকের ভিডিও বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের ফাঁদে ফেলে। সেখানে ধর্মীয় বাণী ও শান্তি ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হতো। যোগাযোগের পর শুরু হতো আসল খেলা।
প্রথম ধাপ: ‘কাফনের কাপড়’ বা বিশেষ পণ্যের নামে টাকা আদায়।
দ্বিতীয় ধাপ: ‘পটাশ’ ও চিনি দিয়ে হাত পুড়িয়ে ভয় দেখানো এবং ১০ হাজার টাকা পাঠানোর শর্ত দেওয়া।
তৃতীয় ধাপ: নারীদের ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও পাঠাতে বাধ্য করে ব্ল্যাকমেইল শুরু করা।
এভাবেই কুষ্টিয়ার এক নারী তার ১৪ লাখ টাকা খুইয়েছেন। সিআইডি বলছে, অনেক ভুক্তভোগী লোকলজ্জার ভয়ে অভিযোগ করেন না, ফলে এই অপরাধীরা পার পেয়ে যায়।
সম্প্রতি আব্দুস সবুর নামে এক প্রতারক গ্রেপ্তার হলেও, তার মতো আরও অনেকেই ফেসবুকের ৭টি পেজ ব্যবহার করে এই প্রতারণা চালাচ্ছিল। এই ঘটনাগুলো কি কেবল প্রতারকদের ব্যক্তিগত অপরাধ, নাকি এটি আমাদের সমাজের একটি গভীর অবক্ষয়কে নির্দেশ করে? যেখানে মানুষ বিজ্ঞান ও যুক্তির বদলে কুসংস্কারের ওপর ভরসা করে?
প্রশ্ন হলো, যখন প্রযুক্তি মানুষের জীবন সহজ করার কথা, তখন তা কেন এমন প্রতারণার হাতিয়ার হয়ে উঠছে? আর কতজন নারীকে এমন 'তান্ত্রিক বাবা'দের ফাঁদে পড়ে নিজেদের সম্মান ও সম্পদ হারাতে হবে?